
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) বছরের পর বছর ধরে কিছু অসাধারণ ক্রিকেটীয় কৃতিত্বের সাক্ষী হয়েছে। শ্বাসরুদ্ধকর সেঞ্চুরি থেকে শুরু করে মনোমুগ্ধকর বোলিং পারফরম্যান্স, এই লিগ ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়ে অসংখ্য স্মরণীয় মুহূর্ত তৈরি করেছে। আসন্ন বিপিএল ২০২৫-এর উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বিপিএল ইতিহাস এর সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস এবং সেরা বোলিং ফিগার, যেখানে দেশীয় এবং বিদেশি খেলোয়াড়দের অসাধারণ পারফরম্যান্স তুলে ধরা হয়েছে।
বিপিএল এর ইতিহাসের এক ঝলক
২০১২ সালে শুরুর পর থেকে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) ক্রিকেটারদের জন্য নিজেকে প্রমাণ করার এক দারুণ মঞ্চ হয়ে উঠেছে। প্রতিটি মৌসুম নিয়ে আসে উত্তেজনা, রোমাঞ্চকর মুহূর্ত এবং অমলিন পারফরম্যান্স। অতীতের মৌসুমগুলোতে ফিরে তাকালে দুটি বিশেষ মুহূর্ত আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে: দেশীয় এবং বিদেশি খেলোয়াড়দের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস এবং টুর্নামেন্টকে সংজ্ঞায়িত করা সেরা বোলিং ফিগার।
বিপিএল এর ইতিহাস এ সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস
স্থানীয় খেলোয়াড়: তামিম ইকবাল এর দুর্দান্ত ইনিংস (৬১ বলে ১৪১* রান)

তামিম ইকবালের অসাধারণ ইনিংসটি ২০১৯ বিপিএল ফাইনালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের (CV) হয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি খেলোয়াড়ের সর্বোচ্চ স্কোর হিসেবে রয়েছে। ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, মিরপুরে ঢাকা ডায়নামাইটসের (ডিডি) বিপক্ষে তামিম খেলেন এক দুর্দান্ত ইনিংস, যেখানে তিনি মাত্র ৬১ বল থেকে অপরাজিত ১৪১ রান করেন। এই ইনিংসে ছিল ১০টি চার এবং ১১টি ছয়, এবং তাঁর স্ট্রাইক রেট ছিল অভূতপূর্ব- ২৩১.১৪।
তামিমের এই অনবদ্য পারফরম্যান্স কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে তাদের দ্বিতীয় বিপিএল শিরোপা এনে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চাপের মধ্যে তামিমের এই অসাধারণ ইনিংস শুধুমাত্র তার শট নির্বাচনের জন্যই নয়, বরং যেভাবে তিনি ফাইনালের মত বড় মঞ্চে ঠাণ্ডা মাথায় দলকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেটি বাংলাদেশি ক্রিকেটের আত্মাকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে। এটি ছিল একটি অবিস্মরণীয় পারফরম্যান্স।
বিদেশি খেলোয়াড়: ক্রিস গেইল এর বিধ্বংসী ইনিংস (৬৯ বলে ১৪৬* রান)

বিপিএল এর সর্বোচ্চ স্কোরের আলোচনায় কিংবদন্তি ক্রিস গেইলকে উল্লেখ না করে তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। রংপুর রাইডার্সের (আরআর) হয়ে গেইল ২০১৭ বিপিএলের ফাইনালে ঢাকা ডায়নামাইটসের (ডিডি) বিপক্ষে এক অনবদ্য পারফরম্যান্স দেখান। ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭ তারিখে মিরপুরে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচে গেইল মাত্র ৬৯ বল খেলে ১৪৬ রান করেন। তার এই ইনিংসে ছিল ৫টি চার এবং রেকর্ডসংখ্যক ১৮টি ছয়, এবং তার স্ট্রাইক রেট ছিল ২১১.৫৯।
গেইলের এই শ্বাসরুদ্ধকর ইনিংস রংপুর রাইডার্সকে তাদের প্রথম বিপিএল শিরোপা জেতাতে বিশাল অবদান রাখে। তার এই রেকর্ডভাঙা পারফরম্যান্স প্রমাণ করে কেন তাকে “ইউনিভার্স বস” বলা হয় এবং কেন তিনি টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের এক সত্যিকারের কিংবদন্তি।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) এর ইতিহাসে শীর্ষ পাঁচ রান সংগ্রাহক: ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
বিপিএল এর ইতিহাস এ সেরা বোলিং ফিগার
যেখানে ব্যাটিং সাধারণত বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করে, সেখানে অসাধারণ বোলিং পারফরম্যান্স ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিপিএল এমন কিছু অসাধারণ বোলিং প্রদর্শনী দেখেছে, যা টুর্নামেন্টের ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে।
স্থানীয় খেলোয়াড়: আবু হায়দার রনি অসাধারণ স্পেল (৫/১২)

১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, বিপিএল সিজন ১০-এ ৩৮তম ম্যাচে ফরচুন বরিশাল (এফবি) এর বিপক্ষে রংপুর রাইডার্স (আরআর) এর হয়ে আবু হায়দার রনি চট্টগ্রামে এক অবিশ্বাস্য বোলিং স্পেল উপহার দেন। ৪ ওভারে মাত্র ১২ রান দিয়ে ৫টি উইকেট শিকার করেন তিনি, যার মধ্যে ছিল ১৬টি ডট বল এবং মাত্র একটি বাউন্ডারি। তার ইকোনমি রেট ছিল মাত্র ৩.০০!
রনির এই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স রংপুর রাইডার্সের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এটি তাদের দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার এ পৌঁছাতে সাহায্য করে। তার শৃঙ্খলাপূর্ণ বোলিং এবং বুদ্ধিদীপ্ত বৈচিত্র্য প্রমাণ করে কেন তিনি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা টি-টোয়েন্টি বোলার হিসেবে বিবেচিত হন।
বিদেশি খেলোয়াড়: মোহাম্মদ আমির এর জাদুকরী স্পেল (৬/১৭)

১৩ জানুয়ারি, ২০২০, বিপিএল সিজন ৭-এর প্রথম কোয়ালিফায়ারে খুলনা টাইগার্সের (কেটি) হয়ে রাজশাহী রয়্যালসের (আরআর) বিপক্ষে মোহাম্মদ আমির এক অভাবনীয় স্পেল করেন, যা বিপিএল ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। মিরপুরে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচে আমির তার ৪ ওভারের স্পেলে মাত্র ১৭ রান দিয়ে ৬টি উইকেট শিকার করেন। তার স্পেলে ছিল ১৭টি ডট বল এবং দুর্দান্ত ইকোনমি রেট ৪.২৫।
রাজশাহী রয়্যালস সেই মৌসুমে ফাইনালে পৌঁছালেও আমিরের এই পারফরম্যান্স টুর্নামেন্টের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। চাপের মুখে তার এমন পারফরম্যান্স তার দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার পরিচয় দেয়। তার সুইং এবং সিম বোলিংয়ের এই প্রদর্শনী দর্শক এবং সমালোচকদের থেকে প্রচুর প্রশংসা কুড়ায়। এটি ছিল তাঁর অবিস্মরণীয় এক বোলিং পারফরম্যান্স।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) এর ইতিহাসে সেরা পাঁচ উইকেট-শিকারী: ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
বিপিএল ২০২৫: কী আশা করা যায়?
বিপিএল ২০২৫ যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই নতুন রেকর্ড এবং চমৎকার পারফরম্যান্সের আশায় উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছে। অভিজ্ঞ তারকা এবং উদীয়মান প্রতিভার উপস্থিতি এবারের টুর্নামেন্টকে আরও রোমাঞ্চকর করে তুলবে। ব্যাট এবং বলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই উপভোগ করার জন্য দর্শকরা মুখিয়ে আছেন।
সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম-এর মতো দেশীয় তারকা এবং আন্দ্রে রাসেল, রশিদ খান-এর মতো বিদেশি খেলোয়াড়দের আলো ছড়ানোর প্রত্যাশা রয়েছে। এদিকে একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার জন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো নিজেদের স্কোয়াড শক্তিশালী করে তুলছে। এর ফলে টুর্নামেন্ট জুড়ে উচ্চমানের ক্রিকেট দেখা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
মিরপুর, চট্টগ্রাম, এবং সিলেটের মতো ভেন্যুগুলো ভিন্ন ভিন্ন পিচ এবং কন্ডিশন সরবরাহ করবে, যা ব্যাটসম্যান এবং বোলারদের মানিয়ে নিতে বাধ্য করবে। বিদ্যমান রেকর্ড ভাঙার জন্য খেলোয়াড়দের প্রচেষ্টা টুর্নামেন্টের উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
উপসংহার
বিপিএল বছরের পর বছর ধরে ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য স্মরণীয় মুহূর্ত উপহার দিয়ে আসছে। তামিম ইকবালের ১৪১*, ক্রিস গেইলের ১৪৬*, আবু হায়দার রনির ৫/১২, এবং মোহাম্মদ আমিরের ৬/১৭ এর মতো অসাধারণ পারফরম্যান্স ক্রিকেট ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে আছে। টুর্নামেন্টের বিকাশের সাথে সাথে এই রেকর্ডগুলো উৎকর্ষতার মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা খেলোয়াড়দের নিজেদের সীমা অতিক্রম করতে অনুপ্রাণিত করে।
বিপিএল ২০২৫-এর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, নতুন তারকাদের আবির্ভাব এবং নতুন ইতিহাস গড়ার মঞ্চে এবারের আসরের আলোচিত নাম কে হবে? বিপিএল ২০২৫ শুধুমাত্র এক প্রতিযোগিতা নয়, বরং এটি ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য হবে রোমাঞ্চকর মুহূর্ত উপভোগের এক দুর্দান্ত সুযোগ।