আইসিসি নারী টি২০ বিশ্বকাপ ২০২৪ তার নবম সংস্করণ উদযাপন করেছে, যা নারী ক্রিকেটের জন্য এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। এই আসরে নিউজিল্যান্ড নারী দল প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতে নিয়ে গৌরব অর্জন করেছে। এর আগে ২০০৯ ও ২০১০ সালে নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ-এ দুবার ফাইনালে উঠে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েছিল কিউইরা। সেই দলটি ১৪ বছর পর আবার ফাইনালে উঠে দোর্দণ্ড প্রতাপেই জিতে নিল নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ।
এবারের টুর্নামেন্টটি সংযুক্ত আরব আমিরাত-এ (ইউএই) অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে মোট ২৩টি রোমাঞ্চকর ম্যাচ খেলা হয়েছিল। ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হয় দুটি আইকনিক ভেন্যুতে:
- শারজা ক্রিকেট স্টেডিয়াম, শারজা- দ্বিতীয় সেমিফাইনাল সহ মোট ১১টি ম্যাচ
- দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, দুবাই- প্রথম সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল সহ মোট ১২টি ম্যাচ
টুর্নামেন্টটিতে মোট ১০টি দল অংশগ্রহণ করে, যেখানে ছিল রোমাঞ্চকর প্রতিযোগিতা ও অসাধারণ পারফরম্যান্সে পরিপূর্ণ এবং ক্রিকেটপ্রমীরা এবার নতুন চ্যাম্পিয়নদের অভিষেক হতে দেখেছে। তবে এই ইভেন্টটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার পুরুষ এবং নারী ক্রিকেট দলের জন্য, কেননা এই বছর উভয়ই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এর ফাইনালে পৌঁছালেও কেউই শিরোপা জিততে পারেনি।
রোমাঞ্চকর লড়াই: গ্রুপ পর্বের সারসংক্ষেপ
এবারের গ্রুপ পর্বে অসাধারণ কিছু ম্যাচ এবং ব্যতিক্রমী ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স দেখা গিয়েছে। এবার ১০টি দলকে দুটি প্রতিযোগিতামূলক গ্রুপে বিভক্ত করা হয়:
গ্রুপ এ – অস্ট্রেলিয়া নারী, নিউজিল্যান্ড নারী, ভারত নারী, পাকিস্তান নারী, এবং শ্রীলঙ্কা নারী।
গ্রুপ এ- এর পয়েন্ট টেবিল:
পজিশন | দল | ম্যাচ | জয় | পরাজয় | পয়েন্ট | নেট রান রেট |
১ | অস্ট্রেলিয়া নারী | ৪ | ৪ | ০ | ৮ | ২.২২৩ |
২ | নিউজিল্যান্ড নারী | ৪ | ৩ | ১ | ৬ | ০.৮৭৯ |
৩ | ভারত নারী | ৪ | ২ | ২ | ৪ | ০.৩২২ |
৪ | পাকিস্তান নারী | ৪ | ১ | ৩ | ২ | -১.০৪০ |
৫ | শ্রীলঙ্কা নারী | ৪ | ০ | ৪ | ০ | -২.১৭৩ |
গ্রুপ বি – ওয়েস্ট ইন্ডিজ নারী, দক্ষিণ আফ্রিকা নারী, ইংল্যান্ড নারী, বাংলাদেশ নারী, এবং স্কটল্যান্ড নারী।
গ্রুপ বি- এর পয়েন্ট টেবিল:
পজিশন | দল | ম্যাচ | জয় | পরাজয় | পয়েন্ট | নেট রান রেট |
১ | ওয়েস্ট ইন্ডিজ নারী | ৪ | ৩ | ১ | ৬ | ১.৫৩৬ |
২ | দক্ষিণ আফ্রিকা নারী | ৪ | ৩ | ১ | ৬ | ১.৩৮২ |
৩ | ইংল্যান্ড নারী | ৪ | ৩ | ১ | ৬ | ১.০৯১ |
৪ | বাংলাদেশ নারী | ৪ | ১ | ৩ | ২ | -০.৮৪৪ |
৫ | স্কটল্যান্ড নারী | ৪ | ০ | ৪ | ০ | -৩.১২৯ |
গ্রুপ পর্বের কিছু স্মরণীয় ম্যাচ
- অস্ট্রেলিয়া বনাম ভারত: অস্ট্রেলিয়া ৯ রানে জয়ী হয়ে গ্রুপ এ- এর শীর্ষস্থান নিশ্চিত করে।
- ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা: ক্যারিবীয় দল ৬ উইকেটে জিতে গ্রুপ বি- এর শীর্ষে উঠে আসে।
- ভারত বনাম পাকিস্তান: এই ক্লাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভারত ৬ উইকেটে জয়ী হয়, যা তাদের গ্রুপ এ-তে তৃতীয় স্থান নিশ্চিত করে। ফলে তারা টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ে।
আরও পড়ুন: আইসিসি নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাঁচ শীর্ষস্থানীয় উইকেট-শিকারী: ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
নকআউট পর্ব: ফাইনাল এর যাত্রা
নকআউট পর্বে প্রতিটি গ্রুপের শীর্ষ দুই দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, যা টুর্নামেন্টের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ক্রিকেট ম্যাচ প্রদর্শন করেছে।
১ম সেমিফাইনাল (দুবাই): অস্ট্রেলিয়া নারী বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা নারী
অস্ট্রেলিয়ার দেয়া ১৩৫ রান তাড়া করতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকা ১৭.২ ওভারে ৮ উইকেট হাতে রেখে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায়। যার ফলশ্রুতি নারী টি২০ বিশ্বকাপে টানা দ্বিতীয়বারের ন্যায় ফাইনালে উঠে তারা।
২য় সেমিফাইনাল (শারজা): নিউজিল্যান্ড নারী বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ নারী
ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর বিপক্ষে লড়াইপূর্ণ ম্যাচে ব্ল্যাকক্যাপস’রা ৮ রানে জয়ী হয়ে ফাইনালে জায়গা করে নেয়, যা টুর্নামেন্টে তাদের গভীরতা এবং সংকল্পের বহিঃপ্রকাশ।
ফাইনাল: নিউজিল্যান্ড এর ঐতিহাসিক বিজয়
দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত গ্র্যান্ড ফাইনালটি নিউজিল্যান্ড নারী এবং দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের মধ্যে ছিল একটি রোমাঞ্চকর লড়াই। প্রথমে ব্যাট করে নিউজিল্যান্ড নারী ১৫৮/৫ রান সংগ্রহ করে। ব্যাট এবং বল উভয় ক্ষেত্রেই অ্যামেলিয়া কার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকা চাপের মধ্যে পড়ে, ২০ ওভারে ১২৬/৯ রান তুলতেই গুটিয়ে যায়।
ফলে টানা দ্বিতীয়বারের মত রানার্সআপ হওয়ার যন্ত্রণা পায় দক্ষিণ আফ্রিকা।
কিউদের অসাধারণ বোলিংয়ে খেলার পুরো সময় ম্যাচ নিজদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল নিউজিল্যান্ড। ফলে ৩২ রানের জয় নিয়ে নিউজিল্যান্ড নারী দল প্রথম বারের মত আইসিসি নারী টি২০ বিশ্বকাপ এর শিরোপা ঘরে তোলে, যা নারীদের ক্রিকেটে নতুন যুগের সূচনা করে। পুরো টুর্নামেন্টে ধারাবাহিক পারফর্মেন্সের সুবাদে অ্যামেলিয়া কার প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ এবং সিরিজ নির্বাচিত হন।
টুর্নামেন্টের উল্লেখযোগ্য পারফর্মার
কয়েকজন খেলোয়াড় স্মরণীয় পারফরম্যান্স করেছেন, যা টুর্নামেন্টের উত্তেজনায় বড় অবদান রেখেছে:
শীর্ষ রান-সংগ্রাহক এবং সর্বাধিক চার: লরা উলভার্ট (দক্ষিণ আফ্রিকা নারী দলের অধিনায়ক)
- ম্যাচ: ৬
- রান: ২২৩
- বল ফেসড: ১৯৭
- সর্বোচ্চ স্কোর: ৫৯*
- গড়: ৪৪.৬০
- স্ট্রাইক রেট: ১১৩.২০
- চার: ২৪ (টুর্নামেন্টের সর্বাধিক)
- ছয়: ২
সর্বাধিক ছয় এবং সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেট: ডিয়েন্ড্রা ডটিন (ওয়েস্ট ইন্ডিজ নারী)
- ৯ ছয় (৫ ইনিংস)
- স্ট্রাইক রেট: ১৬২.১৬ (টুর্নামেন্টের সর্বাধিক)
- ব্যাটিং গড়: ৪০
শীর্ষ উইকেট শিকারী এবং অলরাউন্ডার: অ্যামেলিয়া কার (নিউজিল্যান্ড নারী)
বোলিং পরিসংখ্যান:
- ম্যাচ: ৬
- উইকেট: ১৫
- বল: ১৩৬
- রান: ১১০
- সেরা বোলিং-ফিগার: ৪/২৬
- গড়: ৭.৩৩
- ইকোনমি রেট: ৪.৮৫
ব্যাটিং পরিসংখ্যান:
- রান: ১৩৫
- বল ফেসড: ১৫০
- সর্বোচ্চ স্কোর: ৪৩
- গড়: ২৭
- স্ট্রাইক রেট: ৯০
- চার: ১০
সেরা বোলিং ইকোনমি: তাহলিয়া ম্যাকগ্রাথ (অস্ট্রেলিয়া মহিলা)
- ইকোনমি রেট: ৪.০০ (৩ ম্যাচে)
- বোলিং গড়: ১৬
আরও পড়ুন: আইসিসি নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাঁচ শীর্ষ রান সংগ্রাহক: ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
টুর্নামেন্ট এর প্রভাব
আইসিসি নারী টি২০ বিশ্বকাপ ২০২৪- নারী ক্রিকেটে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নিউজিল্যান্ড প্রথমবারের মতো ট্রফি তুলে নিয়েছে, যা প্রমাণ করেছে যে নারী ক্রিকেটের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও, দক্ষিণ আফ্রিকা পুরুষ এবং নারী উভয় দলেরই এই বছর ফাইনালে পৌঁছানো তাদের ক্রিকেটের সম্প্রসারণকেই নির্দেশ করছে।
এই সংস্করণটি মাল্টি-ডাইমেনশনাল খেলোয়াড়দের গুরুত্বকেও তুলে ধরেছে, যেমন অ্যামেলিয়া কার, যিনি ব্যাট এবং বল উভয় ক্ষেত্রেই অসাধারণ ছিলেন। লরা উলভার্ট এর ধারাবাহিক ব্যাটিং এবং ডিয়েন্ড্রা ডটিন এর আক্রমণাত্মক হিটিং নারীদের এই টুর্নামেন্টের উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়েছে।
উপসংহার
আইসিসি নারী টি২০ বিশ্বকাপ ২০২৪-এর নবম সংস্করণ ছিল এক স্মরণীয় আসর, যেখানে নিউজিল্যান্ড প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতে ইতিহাস গড়েছে। ইউএই-এর দুটি চিত্রশোভিত ভেন্যু জুড়ে অনুষ্ঠিত এই টুর্নামেন্টটি শুধুমাত্র নারীদের ক্রিকেটের উন্নয়নকে প্রকাশিতই করেনি বরং ভবিষ্যত তারকাদের জন্য মঞ্চও প্রস্তুত করেছে। রোমাঞ্চকর ম্যাচ, তারকা পারফরম্যান্স এবং নতুন চ্যাম্পিয়নদের আবির্ভাব নারী ক্রিকেটের ভবিষ্যৎকে আরও উজ্জ্বল করে তুলবে।
নিউজিল্যান্ডের এই বিজয় হাজার হাজার তরুণ খেলোয়াড়কে অনুপ্রাণিত করবে, এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে গৌরবের পথে যাওয়া নারী টি২০ বিশ্বকাপ ২০২৪- ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে।