তাকে বলা হয় ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার । যিনি ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অনেক বোলারের রাতের ঘুমেই কেড়ে নিয়ে ছিলেন, সেই তার ঘুমেই কিনা কেড়ে নিয়ে ছিলেন এক তরুনী? অনেক সিনেমাতেই দেখা যায় প্রথম দেখাতেই একে অপরের প্রেমে পড়েন নায়ক নায়িকা। কিন্ত বাস্তবে? হ্যা, এটা কোন বলিউড নায়ক নায়িকার প্রেমের গল্প নয়, গল্পটা ক্রিকেট কিংবদন্তি শচীন রমেশ টেন্ডুলকার আর অঞ্জলি মেহতার।
ঘটনাটি ১৯৯০ সালের। মা অ্যানাবেল মেহতাকে বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করতে বান্ধবীকে নিয়ে মুম্বাই বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন অঞ্জলি। সেই সময় সেই ফ্লাইটেই ইংল্যান্ড সফর শেষে দেশে ফিরছিলেন ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট দল। ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে নিজেদের ব্যাগের জন্য অপেক্ষা করছিলো ক্রিকেটাররা। তখনই বাইরে থেকে গ্লাসের ভেতর ১৭ বছরের এক টগবগে তরুনকে দেখে চোখ আটকে যায় অঞ্জলির। সাথে থাকা বান্ধবী অপর্ণা সান্থানামের মারফতে জানতে পারেন ছেলেটি দুর্দান্ত পারফর্মার। ইংল্যান্ডে গত সিরিজেই করেছেন দুর্দান্ত সেঞ্চুরি।
ডাক্তারি পড়ুয়া মেয়েটির ক্রিকেটে বিন্দুপরিমানও আগ্রহ ছিল না। কিন্ত ভারতের মত ক্রিকেট পাগল দেশে, ক্রিকেট ক্রেজ ছুয়ে গেল অঞ্জলিকেও। শচীন বিমানবন্দরের বাইরে বের হতেই অটোগ্রাফের জন্য শচীনের পিছনে ভৌ দৌড় দেন অঞ্জলি। শচীন খেয়াল করলেন মেয়েটির পরনে কমলা রঙের টি-শার্ট এবং নীল জিন্স। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে রীতিমতো ভড়কে যান শচীন। আর কেনই বা যাবেন না! তিনি বেশ ভালো করেই জানেন বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করছেন তার ভাই অজিত আর নীতিন।
অবশ্য সাথে থাকা ছোটবেলার বন্ধু সুনীল হারশে শচীনের কানে কানে বললেন, “দ্যাখ, কত সুন্দর একটা মেয়ে তোর নাম ধরে ডাকছে। নিশ্চয়ই আলাপ করতে চায়!” কিন্তু নিতান্ত বাধ্য হয়েই শচীন তাকে বললেন, “অজিত আর নীতিনের সামনে কোনোভাবেই মেয়েটার সাথে কথা বলা সম্ভব নয়।” এদিকে, শচীনের পিছনে দৌড়াতে যেয়ে মায়ের কথা একদমই ভুলে গিয়েছিলেন অঞ্জলি।
সেদিনের পর শচীনের সাথে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেন অঞ্জলি। চোখাচোখি হলেও অঞ্জলির সাথে যোগাযোগের কোন চেষ্টাই করেন নি শচীন। অঞ্জলির কলেজের একজন কাছের বন্ধু ছিলেন মুফি, যিনি ক্লাবে খেলতেন। তাকে জোর জবরদস্তি করেই শচীনের ফোন নাম্বার যোগাড় করেন অঞ্জলি। স্বভাবতই, নতুন নাম্বারের কোন ফোন কল দেখলে তা রিসিভ করতেন না ভারতীয় ক্রিকেটের পোস্টারবয়। তবে এইখানে প্রেমটা যে হওয়ারই ছিল। সেদিন তাই অচেনা নাম্বারের কলটা রিসিভ করেন স্বয়ং শচীন। সেখানে নিজের পরিচয়টা দিলে তাকে চিনতে পারেন ক্রিকেট ঈশ্বর। এমনকি সেদিন কি রঙের ড্রেস পরা ছিলেন তিনি সেটাও বলে দেন। প্রেমের গল্পের সেই তো শুরু ৷
এভাবেই কয়েকদিন চলল দুজনের ফোনালাপ। এক পর্যায়ে শচীনের সাথে দেখা করার প্রস্তাব দেন অঞ্জলি। শচীন তাতে সায় দেন, কেননা তিনি নিজেই তো দেখা করার জন্য ছিলেন উদগ্রীব। ক্রিকেট ক্লাব অফ ইন্ডিয়ায় (সিসিআই) দেখা করার জন্য অঞ্জলিকে আমন্ত্রণ জানান শচীন। তবে সেদিন সেখানে এতো ভীড় ছিল যে তারা স্বস্তিতে কথাও বলতে পারেন নি। তবে কথা চলতে থাকলো ফোনে। একজন আরেকজনকে জানতে শুরু করলেন। এই যেমন শচীন জানতে পারেন অঞ্জলি দক্ষিণ মুম্বাইতে বড় হয়েছেন, এবং খুবই সম্ভ্রান্ত একটি পরিবারের মেয়ে। পড়াশোনা করেছেন সেইন্ট জেভিয়ার্স কলেজে, এবং বর্তমানে জে জে হসপিটালে ডাক্তারি পড়ছেন।
দীর্ঘদিন ল্যান্ডলাইনে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে দেখে শচীনকে সন্দেহ করেন তার বৌদি মিনা। এ নিয়ে শচীনের কাছে বেশ কয়েকদিন জানতে চাইলেও লাজুক টেন্ডুলকার বিষয়টি এড়িয়ে যেতেন। অঞ্জলির সাথে শচীনের প্রথম যথাযথ সাক্ষাৎ হয়েছিল তার বাড়িতেই। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সাংবাদিক সেজে টেন্ডুলকারের সাক্ষাৎকার নিতে যান অঞ্জলি। বাড়িতে গিয়ে যখন শচীনকে তিনি চকলেট দেন, তখন তা দেখে ফেলেন শচীনের মা। তখন তিনি সরাসরি অঞ্জলিকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি কি সত্যিই সাংবাদিক?
এরপর দীর্ঘ পাঁচ বছর চুটিয়ে প্রেম করেছেন শচীন – অঞ্জলি । তারকাখ্যাতির কারনে একসঙ্গে ঘুরতে বের হতে পারতেন না। তাই বলে কি থেমে থাকবে প্রেম? একবার দুজনে অনেকটা লুকিয়ে সিনেমা হলে দেখতে গেলেন ‘রোজা’ সিনেমা। তবে খ্যাতির বিড়েম্বনায় সিনেমাটি পুরোপুরি দেখতেও পারেন নি শচীন। সিনেমার বিরতীতে হলের উপস্থিত দর্শকেরা তাকে চিনে ফেলায় তাৎক্ষণিক সেই জায়গা ত্যাগ করেন তিনি। অঞ্জলির ইচ্ছা রক্ষার্থে তাকে চিনে ফেলার ভয় থাকার পরেও মেরিন ড্রাইভে যেয়ে ডাবের পানি খেয়েছেন দু’জন। সেদিনই জীবনে প্রথম ও শেষবার তারা এয়ার ইন্ডিয়া ভবনের বিপরীত পাশের বেঞ্চিতে বসে প্রেম করেছিলেন।
এরপর শচীনের প্রেম গড়িয়েছে বিয়ে অব্দি। পাঁচ বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর দুই পরিবারকে জানিয়ে বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হন জনপ্রিয় এই জুটি।
দ্যা গ্রেট ওয়াল খ্যাত রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস ভিভিএস লক্ষ্মণ কিংবা সৌরভ গাঙ্গুলির মতো কিংবদন্তীদের সাথে কতশত ঐতিহাসিক জুটি বেঁধেছেন ভারতের ক্রিকেটে ভগবান।
সেই জুটিগুলো ক্ষণস্থায়ী হলেও চিকিৎসক অঞ্জলি মেহতার সাথে ২৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে চিরস্থায়ী জুটি বেঁধেছেন শচীন। শচীন -অঞ্জলির প্রেমের গল্প যেন হার মানায় রোমান্টিক কোন সিনেমাকেও।